প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
নিকোলা টেসলা জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৬ সালের ১০ জুলাই, বর্তমান ক্রোয়েশিয়ার স্মিলজান নামক স্থানে, যা তখন অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁর বাবা মিলুতিন টেসলা ছিলেন একজন সার্বিয়ান অর্থোডক্স পুরোহিত, আর মা জর্জিনা টেসলা ছিলেন একজন গৃহিণী, যিনি প্রযুক্তির প্রতি প্রবল আগ্রহী ছিলেন এবং নিজের হাতে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র তৈরি করতেন। ছোটবেলা থেকেই টেসলার স্মৃতিশক্তি ছিল অবিশ্বাস্য, তিনি গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে দক্ষ হয়ে ওঠেন খুব অল্প বয়সেই।
টেসলা প্রথমে গ্রাজ টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে প্রকৌশল বিদ্যায় পড়াশোনা করেন। এরপর তিনি প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু সময়ের জন্য পড়াশোনা করেন, যদিও স্নাতক ডিগ্রি তিনি শেষ করেননি। শিক্ষাজীবনেই তিনি বিভিন্ন উদ্ভাবনী ধারণা নিয়ে কাজ করতে শুরু করেন এবং তার বিদ্যুৎ নিয়ে ভাবনা একেবারেই প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে ছিল।
---
কার্যজীবনের সূচনা ও আমেরিকায় আগমন
শিক্ষা জীবন শেষে টেসলা প্রথমে ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করেন, যার মধ্যে এডিসনের ইউরোপিয়ান কোম্পানিও ছিল। তিনি যখন প্যারিসে কাজ করছিলেন, তখন তার উদ্ভাবনী দক্ষতা বেশ নজর কাড়ে। পরে ১৮৮৪ সালে তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমান, যেখানে তিনি থমাস এডিসনের সঙ্গে কাজ শুরু করেন।
এডিসনের সঙ্গে টেসলার সম্পর্ক প্রথমদিকে ভালো থাকলেও পরে তা প্রতিযোগিতায় রূপ নেয়। এডিসন ছিলেন সরাসরি প্রবাহ (DC) বিদ্যুৎ ব্যবস্থার প্রবক্তা, আর টেসলা ছিলেন পরিবর্তী প্রবাহ (AC) ব্যবস্থার প্রবক্তা। এই দুই প্রযুক্তির মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়, যা ইতিহাসে "কারেন্ট ওয়ার" নামে পরিচিত। টেসলা পরে এডিসনের কোম্পানি ছেড়ে জর্জ ওয়েস্টিংহাউসের সঙ্গে কাজ শুরু করেন এবং AC বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
---
উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার ও অবদান
১. পরিবর্তী প্রবাহ (Alternating Current - AC)
টেসলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল পরিবর্তী প্রবাহ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা। তিনি দেখান যে পরিবর্তী প্রবাহ ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎকে দূরত্বে স্থানান্তর করা সহজ এবং কার্যকর হয়। এই প্রযুক্তি আজও বিশ্বব্যাপী বিদ্যুৎ সরবরাহের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
২. টেসলা কুণ্ডলী (Tesla Coil)
১৮৯১ সালে তিনি টেসলা কুণ্ডলী আবিষ্কার করেন, যা উচ্চ ভোল্টেজ এবং উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে পারে। এটি বেতার শক্তি সঞ্চালন, রেডিও যোগাযোগ, এবং বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
৩. বেতার যোগাযোগ ও রেডিও প্রযুক্তি
গুগলিয়েলমো মার্কোনিকে সাধারণত রেডিওর আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু টেসলা বহু আগেই বেতার সংকেত স্থানান্তরের ধারণা দিয়েছিলেন এবং ১৮৯৩ সালে সেন্ট লুইসে একটি পাবলিক ডেমোনস্ট্রেশনের মাধ্যমে রেডিও প্রযুক্তির সম্ভাবনা দেখিয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট টেসলাকেই প্রকৃত রেডিও আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
৪. এক্স-রে গবেষণা
টেসলা এক্স-রে প্রযুক্তির ওপর কাজ করছিলেন এমন সময় উইলহেল্ম রন্টজেন এক্স-রে আবিষ্কারের জন্য স্বীকৃতি পান। তবে, টেসলা তার গবেষণায় প্রমাণ করেছিলেন যে এক্স-রে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
৫. ওয়াই-ফাই ও বেতার শক্তি হস্তান্তর
টেসলা আজ থেকে এক শতাব্দী আগেই বেতার শক্তি সঞ্চালনের ধারণা দিয়েছিলেন। তার "ওয়ার্ডেনক্লিফ টাওয়ার" প্রকল্প ছিল পৃথিবীর যেকোনো স্থানে বেতার শক্তি পৌঁছে দেওয়ার এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প, যা পরে অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায়।
৬. জলবিদ্যুৎ উৎপাদন
নিয়াগ্রা জলপ্রপাতকে কাজে লাগিয়ে প্রথম AC বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তুলতে টেসলার ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। এর মাধ্যমে দূর-দূরান্তে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
৭. রোবোটিক্স ও দূরনিয়ন্ত্রিত যানবাহন
১৮৯৮ সালে তিনি দূরনিয়ন্ত্রিত বোটের ধারণা দেন, যা আধুনিক রোবটিক্স এবং ড্রোন প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করে।
---
শেষ জীবন ও দারিদ্র্য
টেসলার আবিষ্কারগুলো যুগান্তকারী হলেও তিনি অর্থনৈতিকভাবে কখনো সফল হননি। তার বহু আবিষ্কার ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়, এবং অনেক সময় তিনি তার গবেষণার জন্য তহবিল সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হন। ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি, ৮৬ বছর বয়সে নিউইয়র্কের এক হোটেল কক্ষে তিনি নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
তার মৃত্যুর পর তার সব গবেষণা নথি মার্কিন সরকার জব্দ করে, যা নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব রয়েছে। অনেকে মনে করেন, তার গবেষণাগুলোর মধ্যে এমন কিছু প্রযুক্তি ছিল যা তখনকার সরকার লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিল।
---
উপসংহার
নিকোলা টেসলা ছিলেন এক বিস্ময়কর বিজ্ঞানী, যার আবিষ্কার আধুনিক সভ্যতাকে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। আজকের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, রেডিও, রোবোটিক্স, এবং বেতার প্রযুক্তির মতো বহু ক্ষেত্রেই তার অবদান অনস্বীকার্য। দারিদ্র্য ও অবহেলায় জীবন কাটালেও আজ তিনি বিজ্ঞান জগতের অন্যতম কিংবদন্তি।
তাঁর একটি বিখ্যাত উক্তি:
"If you want to find the secrets of the universe, think in terms of energy, frequency, and vibration."
("যদি তুমি মহাবিশ্বের রহস্য জানতে চাও, তাহলে শক্তি, কম্পন ও ফ্রিকোয়েন্সির দৃষ্টিকোণ থেকে ভাবো।")