পুরো নাম: স্টিফেন উইলিয়াম হকিং
জন্ম: ৮ জানুয়ারি ১৯৪২, অক্সফোর্ড, ইংল্যান্ড
মৃত্যু: ১৪ মার্চ ২০১৮, ক্যামব্রিজ, ইংল্যান্ড
পেশা: তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, বিশ্বতত্ত্ববিদ, লেখক
বিখ্যাত কাজ: ব্ল্যাক হোল, সিংগুলারিটি থিওরি, হকিং রেডিয়েশন, "A Brief History of Time" বই
---
শৈশব ও শিক্ষা
স্টিফেন হকিং জন্মগ্রহণ করেন এমন এক সময়ে, যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। তার বাবা ফ্র্যাঙ্ক হকিং ছিলেন একজন জীববিজ্ঞানী এবং মা ইসোবেল হকিং ছিলেন একজন রাজনৈতিক কর্মী। ছোটবেলা থেকেই স্টিফেন অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন, তবে তার একাডেমিক ফলাফল খুবই গড়পড়তা ছিল।
তিনি প্রথমে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পদার্থবিদ্যা পড়েন, যেখানে তিনি খুব সহজেই তার কোর্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে বিশ্বতত্ত্ব (Cosmology) নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং সেখানে তার অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।
---
এএলএস রোগ ও সংগ্রাম
২১ বছর বয়সে (১৯৬৩) হকিংয়ের শরীরে Amyotrophic Lateral Sclerosis (ALS) ধরা পড়ে, যা স্নায়ুতন্ত্রের একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। ডাক্তাররা বলেছিলেন, তিনি হয়তো মাত্র দুই বছর বাঁচবেন। কিন্তু হকিং নিজের মনের শক্তি দিয়ে বিজ্ঞান চর্চা চালিয়ে যান এবং আরও ৫৫ বছর বেঁচে ছিলেন।
যখন তার চলাফেরা ও কথা বলার ক্ষমতা কমতে থাকে, তখন তিনি একটি বিশেষ কম্পিউটারভিত্তিক ভয়েস সিন্থেসাইজার ব্যবহার শুরু করেন, যার মাধ্যমে তিনি কথা বলতে পারতেন।
---
তাত্ত্বিক গবেষণা ও অবদান
স্টিফেন হকিং মূলত ব্ল্যাক হোল ও মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে কাজ করেছেন। তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হলো:
১. সিংগুলারিটি তত্ত্ব (Singularity Theory)
তিনি গণিতবিদ রজার পেনরোজের সাথে মিলে প্রমাণ করেন যে, বিগ ব্যাং-এর মাধ্যমে মহাবিশ্বের শুরু হয়েছিল এবং এটি একপ্রকার সিংগুলারিটি, যেখানে মহাকর্ষ অসীম হয়ে যায়।
২. হকিং রেডিয়েশন (Hawking Radiation)
তিনি দেখান যে, ব্ল্যাক হোল থেকে বিকিরণ (radiation) বের হতে পারে, যা "হকিং রেডিয়েশন" নামে পরিচিত। এটি ব্ল্যাক হোল সংক্রান্ত প্রচলিত ধারণাকে বদলে দেয়।
৩. মহাবিশ্বের গঠন ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স
তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও সাধারণ আপেক্ষিকতার সমন্বয়ে মহাবিশ্বের একটি নতুন ব্যাখ্যা দেন, যা পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটায়।
---
প্রকাশিত গ্রন্থ
স্টিফেন হকিং বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলো সাধারণ মানুষের জন্য সহজ করে লিখেছেন। তার বিখ্যাত বইগুলো হলো:
A Brief History of Time (১৯৮৮): এটি মহাবিশ্ব, সময়, ব্ল্যাক হোল, আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে লেখা একটি জনপ্রিয় বই, যা ১০ মিলিয়নেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।
The Universe in a Nutshell (২০০১)
Black Holes and Baby Universes (১৯৯৩)
The Grand Design (২০১০)
Brief Answers to the Big Questions (২০১৮, মরণোত্তর প্রকাশিত)
---
ব্যক্তিগত জীবন ও জনপ্রিয়তা
১৯৬৫ সালে তিনি জেন ওয়াইল্ড নামে এক নারীকে বিয়ে করেন এবং তাদের তিনটি সন্তান হয়। পরে ১৯৯৫ সালে তিনি নার্স এলেইন ম্যাসনকে বিয়ে করেন, তবে ২০০৬ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যায়।
হকিং বিজ্ঞানের পাশাপাশি গণমাধ্যমেও জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি "The Simpsons", "Star Trek", "The Big Bang Theory"-এর মতো জনপ্রিয় টিভি সিরিজে উপস্থিত হন।
---
পুরস্কার ও স্বীকৃতি
স্টিফেন হকিং অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন, যেমন:
CBE (Commander of the Order of the British Empire) - ১৯৮২
Presidential Medal of Freedom (যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার) - ২০০৯
Fundamental Physics Prize - ২০১২
Wolf Prize in Physics - ১৯৮৮
---
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
২০১৮ সালের ১৪ মার্চ, আইনস্টাইনের জন্মদিনের দিন, স্টিফেন হকিং মারা যান। তার মৃত্যুতে বিজ্ঞানী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে গভীর শোকের ছায়া নেমে আসে।
স্টিফেন হকিং-এর জীবন আমাদের শেখায় যে, সীমাবদ্ধতা কোনো বাধা নয়। তার সংগ্রাম ও জ্ঞানের আলো সারা বিশ্বকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেছিলেন:
"তোমরা যদি প্রতিবন্ধকতার শিকার হও, তবে সেটিকে তোমার মনের শক্তির কাছে হার মানতে দিও না। কারণ, যেখানে জীবন আছে, সেখানে আশাও আছে।"
---
উপসংহার
স্টিফেন হকিং শুধু একজন বিজ্ঞানী নন, তিনি মানুষের ধৈর্য, অধ্যবসায় ও বুদ্ধিমত্তার এক অনন্য উদাহরণ। তার কাজ আগামী শতাব্দীগুলোতেও মানবজাতিকে নতুন গবেষণার পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।