তোমার অপেক্ষায় (Love Story)

jamiul haque
11 minute read
0
তোমার অপেক্ষায় (Love Story)
প্রথম দেখা

কখনো কখনো কারো সঙ্গে এক মুহূর্তের দেখা বদলে দিতে পারে একটা জীবন। অরণ্যের জন্য সে মুহূর্তটা এসেছিল এক বিকেলে, কলেজের লাইব্রেরিতে।

বাইরে তখন সূর্য অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে, চারদিকে লালচে আভা। লাইব্রেরির বড় কাচের জানালা দিয়ে সেই আলো পড়ছে বুকশেলফের গায়ে, আর তারই নিচে বসে আছে এক মেয়ে। অরণ্য প্রথমেই তার চোখে পড়ে।

মেয়েটির নাম সূর্যী।

সে একা বসে ছিল, সামনে খোলা ছিল একটা পুরনো বই। চারপাশের কোনো শব্দ যেন তার কাছে পৌঁছাচ্ছিল না। অন্যরা যেখানে বন্ধুদের সাথে হাসাহাসিতে ব্যস্ত, সেখানে সে একদম নির্জীব—একটা গল্পের পাতায় হারিয়ে গেছে।

অরণ্যের চোখ আটকে যায়। এমন একটা দৃশ্য সে আগে দেখেনি।

সে এগিয়ে গিয়ে এক পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে। কিন্তু সূর্যী তার দিকে ফিরেও তাকায় না।কৌতূহল বাড়তে থাকে অরণ্যের। কেন সে এত চুপচাপ? কেন সে সবার থেকে আলাদা?

লাইব্রেরিয়ান বই গোছানোর সময় জিজ্ঞেস করেন,
— "অরণ্য, কী চাই?"

সে হেসে বলে,
— "একটা ভালো গল্প।"

— "তবে তো ওর কাছেই যাওয়া উচিত।" লাইব্রেরিয়ান সূর্যীর দিকে ইশারা করেন।

অরণ্য এক মুহূর্ত ভাবল। সত্যিই কি সে যাবে? কিন্তু সূর্যীর শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার সাহস হলো না।

সে শুধু দূর থেকে দেখল, সূর্যী পাতার পর পাতা উল্টে চলেছে। একদম নিজের জগতে ডুবে আছে।

অরণ্য বুঝতে পারল, এই মেয়েটির গল্প জানতেই হবে তাকে।




সূর্যীর নিঃসঙ্গতা

অরণ্য যতই সূর্যীকে দেখছিল, ততই তার কৌতূহল বাড়ছিল। এমন একজন মেয়ে, যে লাইব্রেরির মতো নীরব জায়গায় বসেও আরও নীরব হতে পারে, তার জীবনে নিশ্চয়ই কোনো গভীর গল্প আছে।

সেদিনের পর থেকে অরণ্য প্রায়ই লাইব্রেরিতে যেতে লাগল। বই নেওয়ার অজুহাতে, কখনো বন্ধুকে পড়ার জন্য সাহায্য করতে, আবার কখনো শুধু সূর্যীকে দেখার জন্য।

কিন্তু মেয়েটা যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল তুলে রেখেছে নিজের চারপাশে। সে কারও সাথে কথা বলে না, বন্ধুদের আড্ডায় যায় না, এমনকি কেউ ডাকলেও সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে আবার নিজের বইয়ে মনোযোগ দেয়।অরণ্যের কৌতূহল দমে যায়নি। সে জানতে চেয়েছিল সূর্যীর সম্পর্কে।

একদিন ক্যান্টিনে বন্ধু রুদ্রকে বলল,
— "তুই জানিস, সূর্যী এত একা কেন?"

রুদ্র মাথা চুলকে বলল,
— "শুনেছি ওর পরিবারের অবস্থা ভালো না। বাবা ছোটবেলায় মারা গেছে, মা কঠোর স্বভাবের। কোনোদিন কারও সাথে ভালোভাবে মেশে না। কিন্তু জানিস, ও একসময় অন্যরকম ছিল?"

— "মানে?"

— "স্কুলে ও খুব চঞ্চল ছিল, প্রচুর কথা বলত। ক্লাসে হাসাহাসি করত, কবিতা লিখত। কিন্তু কয়েক বছর আগে হুট করেই বদলে যায়। তারপর থেকে এই নিঃসঙ্গ জীবন শুরু হয়।"

অরণ্য অবাক হলো। কী এমন ঘটেছিল যে এক প্রাণবন্ত মেয়ে এমন নিঃসঙ্গ হয়ে গেল?

সে বুঝতে পারল, সূর্যীর জীবনটা রহস্যে মোড়ানো। আর এই রহস্য তাকে আরও টানতে লাগল।


প্রথম কথা বলা

অরণ্য বুঝতে পারছিল, সূর্যীর জীবনে একটা গভীর দুঃখ লুকিয়ে আছে। সে হয়তো কথা বলে না, হাসে না, কারও সঙ্গে মেশে না—কিন্তু তার চোখের ভাষা বলে দেয়, তার ভেতরে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু তাকে কিভাবে কথা বলানো যায়?

অরণ্য ঠিক করল, সরাসরি কথা বলবে না। সূর্যীর জগতে প্রবেশ করতে হলে অন্য পথ খুঁজতে হবে।

একটি কাগজের টুকরো

সেদিন লাইব্রেরিতে গিয়ে সে ইচ্ছে করেই সূর্যীর সামনে একটা বই রাখল, যেখানে পাতার মধ্যে একটা ছোট্ট কাগজ ঢুকিয়ে দিল। তাতে লেখা ছিল—

"তুমি কি কখনো আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবো, পাখিরা উড়ে বেড়ানোর স্বাধীনতা পেয়েছে, কিন্তু মানুষ কেন নিজের মনকে এত বন্দি করে রাখে?"

কিছুক্ষণ পর সূর্যী বইটা হাতে নিল। সে পাতাগুলো উল্টে যাওয়ার সময় কাগজের টুকরোটা বেরিয়ে এলো।

অরণ্য দূর থেকে দেখল, সূর্যী কিছুক্ষণ কাগজটা ধরে রাখল, তারপর সেটা বইয়ের ভেতরেই রেখে দিল। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই, কোনো চমক নেই।

অরণ্য একটু হতাশ হলো, তবে হাল ছাড়ল না।

দ্বিতীয় চিঠি

পরদিন সে আবার একইভাবে আরেকটি কাগজ রাখল—

"যে শব্দ আমরা মুখে বলতে পারি না, তা কখনো কখনো কাগজে লেখা যায়। তুমি কি আমার সাথে না বলেই কথা বলবে?"

সূর্যী আবার চুপচাপ কাগজটা বের করল, পড়ল, কিন্তু এবার একটা পরিবর্তন হলো। সে কাগজটা বইয়ের ভাঁজে রেখে দিল না, বরং হাতব্যাগে রাখল।

অরণ্য বুঝতে পারল, সূর্যী চিঠিগুলো ফেলে দেয়নি। এর মানে, সে এগুলো গুরুত্ব দিচ্ছে।

তৃতীয় চিঠি: অবশেষে উত্তর

তৃতীয় দিনে অরণ্য যখন লাইব্রেরিতে ঢুকল, তার জন্য একটা সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। তার বইয়ের ভেতরেও একটা ছোট্ট কাগজ ঢোকানো ছিল।

"পাখিরা উড়তে পারে, কারণ তারা ভয় পায় না। মানুষ ভয় পায়। তাই নিজের মনকে বন্দি করে রাখে।"

অরণ্যের মুখে হাসি ফুটে উঠল। অবশেষে সূর্যী প্রথমবার তার সাথে যোগাযোগ করল, যদিও কেবল কাগজের মাধ্যমে।


কাগজের চিঠিতে গড়ে ওঠা সম্পর্ক

সূর্যীর ছোট্ট উত্তরের পর অরণ্য যেন আরও উৎসাহ পেল। এতদিন যে মেয়ে একদম চুপচাপ ছিল, এখন সে অন্তত কাগজের মাধ্যমে হলেও কথা বলছে।

এভাবেই শুরু হলো তাদের নীরব কথোপকথন।

প্রতিদিন লাইব্রেরিতে অরণ্য সূর্যীর জন্য একটা কাগজ রেখে দিত, আর সূর্যী সেটা পড়ে কখনো কখনো উত্তর দিত।

প্রথমবার অনুভূতি ভাগাভাগি

একদিন অরণ্য লিখল—

"তুমি কি কোনোদিন খুব চিৎকার করে কাঁদতে চেয়েছ, কিন্তু পারোনি?"

এবার উত্তর এলো—

"হ্যাঁ, পারিনি। কারণ কাঁদলে কেউ শুনবে, আর আমি চাই না কেউ আমার কান্না শুনুক।"

অরণ্য পড়ে চুপচাপ বসে রইল। সূর্যীর ভেতরে এত দুঃখ লুকিয়ে আছে, সেটা সে অনুভব করতে পারছিল।

সে লিখল—

"কখনো কখনো কাউকে নিজের দুঃখ বললে তা হালকা হয়ে যায়। যদি কখনো বলতে চাও, আমি শুনব।"

এবার উত্তর এল না।

প্রথমবার সরাসরি কথা বলা

অরণ্য ভেবেছিল সূর্যী হয়তো আবার দূরে সরে যাবে, কিন্তু সেটা হলো না।

পরদিন সে লাইব্রেরিতে ঢুকতেই দেখল, সূর্যী তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রথমবার তারা চোখে চোখ রাখল।

কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল, তারপর সূর্যী মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু যাওয়ার আগে সে চুপচাপ একটা কাগজ রেখে গেল অরণ্যের পাশে।

অরণ্য কাগজটা খুলল—

"তুমি এত আগ্রহ দেখাচ্ছ কেন? আমি তো কারও জন্য গুরুত্বপূর্ণ নই।"

অরণ্যের মনে হলো, আজ সরাসরি কথা বলার সময় এসেছে।

সে কাগজে কিছু না লিখে, সোজা গিয়ে সূর্যীর পাশে বসল।

— "সবাই কারও না কারও জন্য গুরুত্বপূর্ণ, সূর্যী। শুধু নিজেকে গুরুত্ব দিতে শিখতে হবে।"

সূর্যী কিছু বলল না, শুধু চুপচাপ রইল।

কিন্তু অরণ্য দেখল, তার চোখের ভেতরে কিছু একটা বদলাচ্ছে।


সূর্যীর অতীতের পর্দা উন্মোচন

অরণ্য বুঝতে পারছিল, সূর্যীর জীবনে এমন কিছু ঘটেছে, যা তাকে বদলে দিয়েছে। সে এত চুপচাপ কেন? কেন সে কারও সঙ্গে মেশে না?

তবে অরণ্য তাড়াহুড়ো করতে চায়নি। সে জানত, সূর্যী নিজে থেকে বলার আগে তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে হয়তো আরও দূরে সরে যাবে।

কিন্তু কিছু কিছু সত্য নিজেই বেরিয়ে আসে।

একটি বিকেল, একটি গল্প

সেদিন কলেজ শেষে হঠাৎ বৃষ্টি এল। বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী তাড়াতাড়ি চলে গেল, কিন্তু সূর্যী আর অরণ্য লাইব্রেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইল।

অরণ্য পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
— "বৃষ্টি তোমার ভালো লাগে?"

সূর্যী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
— "হ্যাঁ, কারণ বৃষ্টির শব্দ কান্নার শব্দ ঢেকে দেয়।"

অরণ্য একটু চমকে গেল। সে জানত, আজ হয়তো কিছু একটা জানার দিন।

— "তুমি কি কাঁদতে চাও?"

সূর্যী মুখ ফিরিয়ে নিল।

— "কাঁদলে কি সব ঠিক হয়ে যাবে?"

অরণ্য বলল,

— "না, কিন্তু হালকা লাগবে।"

সূর্যী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
— "আমার বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মা একদম বদলে গেছেন। ছোটবেলায় তিনি খুব হাসিখুশি ছিলেন, আমাকে নিয়ে গল্প করতেন, রঙিন জামা কিনে দিতেন। কিন্তু বাবা চলে যাওয়ার পর তিনি যেন এক পাথর হয়ে গেলেন।"

অরণ্য নিঃশব্দে শুনছিল।

— "আমার মা বলেন, আবেগ দেখানো মানে দুর্বলতা। তিনি কখনো আমাকে আদর করেন না, কখনো আমার সাথে গল্প করেন না। আমি ছোটবেলা থেকে শিখেছি, চুপ করে থাকাই ভালো। কিছু চাওয়া মানেই কষ্ট পাওয়া।"

সূর্যী এতক্ষণ চোখে চোখ রাখেনি, কিন্তু এবার অরণ্যের দিকে তাকাল।

— "তুমি কেন আমার কথা শুনতে চাও?"

অরণ্য হাসল,
— "কারণ আমি বুঝতে পারি, তুমি একা নও। শুধু নিজেকে একা ভাবো।"

বৃষ্টি তখনও পড়ছে। কিন্তু সূর্যী প্রথমবার একটু নরম হয়ে গেল।

অরণ্য জানত, সে সঠিক পথে এগোচ্ছে।


সূর্যীর মনের দরজা খুলতে শুরু করল

বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু অরণ্য ও সূর্যী তখনও লাইব্রেরির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। সূর্যী প্রথমবার নিজের অতীত নিয়ে মুখ খুলেছে, কিন্তু এখনো অনেক কিছু অব্যক্ত রয়ে গেছে।

অরণ্য জানত, অতীতের স্মৃতিগুলো সহজে ভাগ করে নেওয়া যায় না। মানুষের হৃদয়ের দরজা একদিনে খোলে না, সময় লাগে। তাই সে আর কোনো প্রশ্ন করল না, শুধু পাশে দাঁড়িয়ে থাকল।

একটি নতুন অভ্যাস

পরের কয়েকদিন ধরে সূর্যী আর অরণ্য লাইব্রেরিতে নিয়মিত দেখা করতে লাগল। চিঠির খেলা বন্ধ হয়নি, তবে এবার তারা মাঝে মাঝে সরাসরি কথাও বলে।

একদিন সূর্যী লিখল—

"তুমি কি কখনো অনুভব করেছ, কেউ তোমার খুব কাছের কিন্তু তারপরও অনেক দূরে?"

অরণ্য জবাবে লিখল—

"হ্যাঁ। অনুভব করেছি। কিন্তু আমি জানি, দূরত্ব সবসময় স্থায়ী নয়। কিছু দূরত্ব সময়ের সঙ্গে কমে যায়।"

সূর্যী কিছু লিখল না, শুধু একবার অরণ্যের দিকে তাকিয়ে হাসল। ছোট্ট একটা হাসি, কিন্তু সেটাই ছিল তার দেওয়া প্রথম উপহার।

একটি বিকেল, দুটি কফি

একদিন অরণ্য সূর্যীকে লাইব্রেরি থেকে বের করে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল।

— "তুমি কফি খাও?"

— "কখনো খাইনি।"

— "তাহলে আজ ট্রাই করো।"

সূর্যী একটু দ্বিধায় পড়ল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজি হলো।

কফি এসে গেল। অরণ্য চুমুক দিল, সূর্যীও একবার চেষ্টা করল।

তারপরই মুখ বাঁকিয়ে বলল,
— "এটা এত তেতো কেন?"

অরণ্য হেসে ফেলল।
— "কিছু জিনিস প্রথমবার খারাপ লাগে, কিন্তু ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করে।"

সূর্যী এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, তারপর বলল,
— "তাহলে কি জীবনও তেমন? প্রথমে কষ্ট দেয়, কিন্তু ধীরে ধীরে ভালো হয়ে যায়?"

অরণ্য কিছু বলল না, শুধু মাথা নাড়ল।

সে জানত, সূর্যী আস্তে আস্তে বদলাচ্ছে।


সূর্যীর পরিবর্তন এবং অরণ্যের অনুভূতি স্পষ্ট হওয়া

সূর্যী বদলাচ্ছে। অরণ্য সেটা বুঝতে পারছে।

আগে যে মেয়েটা বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে রাখত, এখন সে মাঝে মাঝে বাইরে তাকায়। লাইব্রেরিতে চুপচাপ বসে থাকা সূর্যী এখন কখনো কখনো ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে আসে।

তার পরিবর্তন এত সূক্ষ্ম যে অন্যরা খেয়াল করে না, কিন্তু অরণ্য দেখে।

অরণ্যের মনে হয়, সূর্যীকে দেখা এখন তার প্রতিদিনের অভ্যাস হয়ে গেছে।

একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন

সেদিন বিকেলে সূর্যী ক্যান্টিনে বসে কফি খাচ্ছিল। এবার সে তেতো স্বাদ নিয়ে কিছু বলল না, বরং শান্তভাবে চুমুক দিল।

হঠাৎ সে জিজ্ঞাসা করল,
— "তুমি আমার সঙ্গে এত সময় কাটাচ্ছ কেন?"

অরণ্য একটু থমকে গেল।

— "মানে?"

— "আমরা তো বন্ধু ছিলাম না, তাও তুমি আমাকে চিনতে চেয়েছ, কথা বলিয়েছ। কেন?"

অরণ্য কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।

সে কি বলবে? সত্যিটা কি বলা উচিত?

তারপর সে ধীরে ধীরে বলল,
— "কখনো কখনো কোনো মানুষকে দেখলেই মনে হয়, তার গল্পটা জানা দরকার। আমি তোমাকে প্রথম দিন দেখেই সেটা অনুভব করেছি।"

সূর্যী কিছু বলল না। শুধু তাকিয়ে থাকল।

তার চোখের গভীরে কিছু একটা খেলা করছিল।

অরণ্যের উপলব্ধি

সেদিন রাতে অরণ্য ঘুমাতে পারেনি।

সে বারবার সূর্যীর কথাগুলো মনে করছিল।

সে কি শুধুই সূর্যীর বন্ধু হতে চেয়েছে? নাকি এর চেয়ে বেশি কিছু?

অরণ্য নিজেকে প্রশ্ন করল—

সে কি সূর্যীকে ভালোবেসে ফেলেছে?


অরণ্যের হৃদয়ের স্বীকারোক্তি

অরণ্যের ভেতরটা যেন এলোমেলো হয়ে গেল। সে নিজেকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করল— হয়তো এটা কেবল বন্ধুত্ব, হয়তো এটা কেবল কৌতূহল।

কিন্তু সত্যিটা পালিয়ে যায়নি।

সে সূর্যীকে ভালোবেসে ফেলেছে।

এমন ভালোবাসা, যেখানে দাবি নেই, প্রত্যাশা নেই—শুধু একজন মানুষের কাছে থাকার ইচ্ছে।

কিন্তু সে এটা কীভাবে বলবে? সূর্যী কি এই অনুভূতিটা বোঝে?

সেদিন ক্যান্টিনে বসে সূর্যী এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে অরণ্যের দিকে তাকিয়েছিল। তার চোখের গভীরতায় যেন হাজারো প্রশ্ন লুকিয়ে ছিল।

অরণ্য বুঝতে পারছিল, সূর্যী তার প্রতি নিরপেক্ষ নয়।

কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশের জন্য শুধু অনুভূতি যথেষ্ট নয়, সাহসও দরকার।

আর সাহসটা অরণ্যের এখনো হয়নি।

একটি নতুন বাঁক

অরণ্য ঠিক করল, হুট করে কিছু বলবে না। আগে সূর্যীকে বোঝার চেষ্টা করবে, তার অনুভূতিগুলো বুঝবে।

কিন্তু গল্পের মোড় ঘুরে গেল এক অপ্রত্যাশিত ঘটনায়।

একদিন ক্লাসের পর অরণ্য যখন লাইব্রেরিতে এল, তখন দেখল সূর্যী নেই। তার প্রিয় জায়গাটা খালি পড়ে আছে।

পরের দিনও এল না।

তারপরের দিনও না।

অরণ্যের অস্বস্তি বাড়তে লাগল। কোথায় গেল সূর্যী?

তিন দিন পর এক বন্ধুর কাছ থেকে শুনল, সূর্যী অসুস্থ। বেশ কয়েকদিন ধরে সে কলেজ আসছে না।

অরণ্যের বুক ধক করে উঠল।

কী হয়েছে তাকে?

সে কি ঠিক আছে?

অরণ্য আর ভাবতে পারল না। সে সিদ্ধান্ত নিল, সূর্যীর খোঁজ সে নিজেই নেবে।


সূর্যীর অসুস্থতা

অরণ্য ঠিক করল, তাকে দেখতে যেতে হবে।

তার চিন্তা যত বাড়ছিল, ততই তার হৃদয়ে একটা অদ্ভুত উদ্বেগ জন্ম নিচ্ছিল। তার মনটা অন্য কোথাও চলে যাচ্ছিল। সূর্যী যে তার অজান্তে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা সে বুঝতে পারছিল না।

পরদিন, সবে দুপুর। অরণ্য সূর্যীর ঠিকানার দিকে রওনা হলো। রাস্তা পেরিয়ে, ছোট্ট একটা গলি, তারপর এক বাড়ি, যেখানে সূর্যী থাকত।

বাড়ি পৌঁছানোর পর, অরণ্য একটু দ্বিধায় পড়ল। কিভাবে শুরু করবে? সূর্যীকে কি সে সরাসরি প্রশ্ন করবে? কিংবা কেবল দেখতে যাবে?

কিন্তু সূর্যীর মা জানালেন, সে এখন ঘুমাচ্ছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এক সপ্তাহ ধরে তার জ্বর যাচ্ছে না।

অরণ্য একদম নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরটা খুব শান্ত ছিল। এমন শান্ত যে, অরণ্য নিজেকে এখানে অচেনা অনুভব করছিল।

তারপরে, সূর্যীর মা বললেন, “তুমি চাইলে, একটু বসতে পারো। সূর্যী সব সময় বলে, তোমার কথা খুব ভালো লাগে।”

অরণ্য কিছুটা অবাক হলো, তবে অস্বস্তি কাটিয়ে বসে পড়ল।

সূর্যী ফিরল, তবে তার মুখে আগে যেমন জৌলুস ছিল না। আজ তার চোখে ক্লান্তি, বিষণ্ণতা।

— "তুমি কেন এলে?" সূর্যী ভাঙা গলায় বলল।

— "তোমার জন্য চিন্তা হচ্ছিল।"

— "আমি ঠিক আছি।"

কিন্তু অরণ্য জানত, তার শরীর ভালো নেই।

একটা নীরব মুহূর্ত ঘনিয়ে এল। অরণ্য সূর্যীর কাছে যাওয়ার সাহস পেল না। সারা রাতের কথা, তার অনুভূতিগুলো, সব কিছুই যেন চাপা পড়েছিল তার মন-মাথায়।

তবে একদিন সূর্যী বলল,
— "আমার মায়ের কথা তুমি জানো?"

অরণ্য চুপ করে ছিল, এরপর সূর্যী বলল,

— "তিন বছর আগে যখন বাবা মারা গেল, মা বদলে গেল। কখনো কথা বলে না, কোনো কিছুতেই মনোযোগ নেই। কষ্টের মধ্যে মানুষ নিজের মধ্যে হারিয়ে যায়।"

অরণ্য তাকে শুধু একদৃষ্টিতে দেখছিল।

সূর্যী হেসে বলল,
— "তবে তুমি আমার পাশে আছো, সেটা ভাবতে ভাল লাগে।"

এবার অরণ্য বুঝতে পারল, সূর্যী কি বলতে চায়।

পার্ট ১০: সূর্যীর সাথে অরণ্যের প্রথম সত্যিকারের কথা বলা

অরণ্য ও সূর্যী অনেক দিন একসাথে ছিল। আস্তে আস্তে তাদের সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে লাগল। কিছু না বললেও, তাদের চাহনি, সঙ্গত কথোপকথন বলছিল অনেক কিছু।

একদিন, যখন তারা ক্যান্টিনে বসে ছিল, সূর্যী বলল,
— "কখনো কি তুমি ভাবো, তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশ্চর্য ঘটনা কী হতে পারে?"

অরণ্য কিছুটা অবাক হয়ে তাকাল,
— "তুমি?"

সূর্যী একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলল,
— "এটা কি শুধু অশুদ্ধতা, না কি মানুষের একে অপরকে ভালোবাসার ক্ষমতা?"

অরণ্য চুপ ছিল, তবে তার মধ্যে এক অনুভূতি ফুটে উঠল— এ মুহূর্তে, সে সূর্যীকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারছে।

— "তুমি জানো, আমি কি মনে করি?" অরণ্য ধীরে ধীরে বলল,
— "সব কিছুই তখনই সুন্দর যখন দুইটি হৃদয় একসাথে অনুভব করে।"

সূর্যী কিছু বলল না, শুধু একধিক দেখে থাকল। তার চোখের গভীরে কিছু পরিবর্তন ছিল। সেই পরিবর্তনটা যেন একে অপরকে উপলব্ধি করার জায়গা তৈরি করছিল।


উন্মুক্ত ভালোবাসা

একদিন, লাইব্রেরিতে বসে অরণ্য সূর্যীকে বলল,
— "তোমার শূন্যতা আমি অনুভব করতে পারি, সূর্যী। তোমার চোখের গভীরে বহু গল্প লুকিয়ে আছে। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই, তোমার সব গল্প শুনতে চাই।"

এবার সূর্যী একটু ধীর পায়ে মাথা নত করল। তারপর বলল,
— "তুমি কি আমার পছন্দ করো?"

অরণ্য, ভীষণভাবে অভ্যস্ত না হওয়া সত্ত্বেও, সোজা চোখে চোখ রেখে বলল,
— "হ্যাঁ, আমি তোমাকে ভালোবাসি।"

সূর্যীর চোখে কেমন এক ত্রুটি ছিল, তারপরই সে অরণ্যের দিকে তাকিয়ে বলল,

— "এটা সঠিক না ভুল, জানি না। কিন্তু আমি অনুভব করি, কিছু জিনিস সবসময় ঠিক হয়।"

এদিন সূর্যীর সাথে অরণ্যের সম্পর্ক নতুন এক দিগন্তে পৌঁছাল। তার ভালোবাসা প্রকাশ পেতে শুরু করেছিল, আর সেই ভালোবাসা দুজনকে একসাথে শক্তি যোগাচ্ছিল।


নতুন দিগন্তে

তাদের সম্পর্ক নতুন আঙ্গিকে শুরু হলো। সূর্যী আর অরণ্য একসাথে অনেক কিছু শিখেছিল। তারা জানত, একে অপরের পাশে থাকার মধ্যে একটা অদৃশ্য শক্তি আছে, যা সব বাধাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করবে।

একদিন, সূর্যী তার হাত অরণ্যের হাতে রাখল। "তুমি কি জানো, তুমি আমার জীবনে এক নতুন সূর্য?"

অরণ্য মৃদু হাসল, "তুমি আমার পৃথিবী, সূর্যী।"

এখন তাদের মধ্যে কোনো দূরত্ব ছিল না। একে অপরকে বুঝতে, অনুভব করতে তারা একে অপরের পাশে ছিল।

শেষ পর্যন্ত, সূর্যী আর অরণ্যের সম্পর্ক একটি নতুন দিগন্তে পৌঁছেছিল, যেখানে প্রেমের আসল অর্থ তারা খুঁজে পেয়েছিল—একসাথে থাকা, একে অপরকে সাহায্য করা এবং সত্যিকারের ভালোবাসার সঙ্গে জীবন কাটানো।

Tags:

Post a Comment

0Comments

Post a Comment (0)